ব্যক্তিত্ব গঠনের চেষ্টা করছি : সুমনা

বাংলাদেশের সঙ্গীত অনেক প্রসিদ্ধ। কালে কালে এদেশ পেয়েছে অনেক গুণি শিল্পীদের। তেমনই একজন ফিজ আপ চ্যানেল আই “সেরা কন্ঠ- ২০১৭” এর চ্যাম্পিয়ন শেখ ফারজানা তাসনিম সুমনা। বয়সে অনেক ছোট হলেও সঙ্গীত নিয়ে যার স্বপ্ন অনেক। বাংলাদেশের মানুষও তাকে নিয়ে অনেক আশাবাদী। একাধারে বহু প্রতিভার অধিকারী সুমনা। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে গৃহবন্দী রয়েছেন তিনি। তার বর্তমান সময়, সঙ্গীত নিয়ে তার ভাবনা, সেই সমস্থ বিষয়গুলো নিয়ে সময় দিলেন “নব যুগান্তর” কে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বার্তায় সাক্ষাৎকার নিলেন শ্রী জীবন কুমার সরকার-
নব যুগান্তর: ঈদ মোবারক।
সুমনা: ঈদ মুবারাক।
নব যুগান্তর: কেমন আছেন আপনি?
সুমনা: চলছে এইতো। চারপাশের যা অবস্থা, ভালো আছি কথাটা বলা কঠিন। তবে, এখন পর্যন্ত সুস্থ আছি, আলহামদুলিল্লাহ।
নব যুগান্তর: ঈদ কেমন কাটলো আপনার?
সুমনা: জীবনের প্রথম গৃহবন্দী ঈদ। চারপাশে মৃত্যুর মিছিল আর আতঙ্ক। তবুও, ভালো থাকার চেষ্টা। মন্দ কাটেনি। পরিবারকে সময় দিয়েছি, নিজেকে সময় দিয়েছি। কারণ ছাড়াই সেজেগুজে বসে থেকেছি। মনের শান্তনা যাকে বলে। হা হা হা।
নব যুগান্তর: তা কেমন কাটছে কোয়ারান্টাইনের গৃহবন্দী সময়গুলো?
সুমনা: একসময় ভাবতাম কবে ছুটি দেবে, কবে ছুটি দেবে! কিন্তু, একেবারেই যে এইভাবে জীবনের এক অনিশ্চয়তার মাঝে পড়তে হবে তা ভাবিনি। এরকম ছুটি কারোই কাম্য নয়। তবে, সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছি। গান নিয়ে ঘাঁটছি, প্রচুর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড গান শুনছি। প্রাকটিসের পরিমান আরও বাড়াচ্ছি। ভোকাল ডেভলপ করছি আরও। ঈদ এর সময় যাচ্ছে। কিছুদিন আগে রোজা শেষ হলো। নামাজ পড়ছি, নিজের ভেতরকার ক্রিয়েটিভিটি সার্চ করছি আরও। ইউটিউব ভিডিও দেখছি। বন্ধুবান্ধব, কাছের মানুষদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সময় দিচ্ছি। আমি খুব ফিল্মি। অনেকেই জানেন না। মুভি প্রেমিক মানুষ। তাই, বিভিন্ন মুভি দেখে সময় কাটাচ্ছি। মাঝেমাঝে রান্না করি। আউট নলেজ বাড়াচ্ছি। বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ছি। এ ছাড়া দিনের বেশিরভাগ সময় আকাশ-বাতাস, মেঘ-বৃষ্টি দেখে কাটিয়ে দেই। সারাদিন এভাবেই যায় কোয়ারেন্টিনে। তবে ঘরে আটকে থাকার অভ্যাস আমার নেই। দম বন্ধ হয়ে আসে। আর কতদিন এভাবে চলবে জানা নেই। প্রিয়মুখগুলোকে ভীষণ মনে পড়ে। আশা রাখছি, খুব দ্রুতই সবার দেখা হবে, সুস্থ শহরে।
নব যুগান্তর: ফিজ আপ চ্যানেল আই সেরা কন্ঠ হওয়ার তো অনেকদিনই হয়ে গেলো। গান নিয়ে এখন স্বপ্ন কি?
সুমনা: সবার আশীর্বাদ, নিজের যোগ্যতা আর মহান আল্লাহর রহমতে নিজের স্বপ্ন পূরণের এক ধাপ পার করলাম। ২০১৭ তে সপ্তম শ্রেণীতে থাকতে সেরাকণ্ঠে নাম লেখাই। এরপর পড়াশোনার দিকটা সামাল দিচ্ছিলাম। চর্চা ছাড়িনি। এই বছরটায় শ্রোতাদের কিছু গান উপহার দেবার ইচ্ছে ছিল। কত প্ল্যানিং ছিল! ইমরান ভাইয়ার সঙ্গে প্রথম ডুয়েট গান, এস আই টুটুল ভাইয়ের সঙ্গে আরেকটি ডুয়েট, নিজের মৌলিক গান রিলিজ দেবার ইচ্ছে ছিল। লকডাউনের কারণে এগোনো হয়নি। তবে, সবসময় ই বলে এসেছি, গান নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। ঠিক, বামুন হয়ে চাঁদ ধরার মতো। জীবনে কিছু ইচ্ছে আছে, আছে স্বপ্ন। জানিনা কতটুকু পারবো, তবে যারা আমার প্রতি আশাবাদী, শুভাকাঙ্খী, আমাকে যারা ভালোবাসেন, আমাকে শোনেন তাদের অনেক কিছু দেবার আছে আমার।
নব যুগান্তর: আপনার স্বপ্নগুলো পূরন হোক। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগের সুমনা এবং বর্তমানের সুমনার মধ্যে কোনো তফাৎ অনুভব করেন কি?
সুমনা: মানুষ হিসেবে আগের সুমনা এবং এখনকার সুমনার তেমন তফাৎ নেই। সাধারণ ছিলাম, আছি, থাকবো। তবে, হ্যাঁ! সময়ের সঙ্গে আরো জানছি, শিখছি, বুঝতে শিখছি। দিন যত যায়, প্রত্যেকটি মানুষেরই দৃষ্টিভঙ্গি, বাচনভঙ্গি এবং মানসিকতায় বৈচিত্রতা আসে। আর, অনেক বিষয়ই তো, প্রকাশ করা যায়না। তবে একটা জিনিসের পরিবর্তন এসেছে। তখন গম্ভীর থাকতাম বেশি, হাসতাম কম। এখন অনেকাংশেই কমে গেছে এই সমস্যা। আমার পুরো নাম শেখ ফারজানা তাসনিম সুমনা। আগে ফারজানা হিসেবে পরিচিত ছিলাম বেশি। আর এখন দুটোই। ব্যক্তিত্ব গঠনের চেষ্টা করছি। তবে, এখনকার সুমনার দায়িত্বটা বেশি।
নব যুগান্তর: সঙ্গীত অঙ্গনের শুরুটা কোথা থেকে হয়েছিল?
সুমনা: সংগীত অঙ্গনেতো পা রেখেছি পরে। বলতে পারেন, সংগীতের শুরুটা কোথায়। বাবার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবো। তবে আমার ছিল বিপরীত। সংগীতের প্রতি আলাদা যে আকর্ষণ ছিল, মা তা লক্ষ্য করেছিলেন প্রথমে। মা বলেন, আমি যখন কাঁদতাম, গান ছেড়ে দিলে কান্না থামিয়ে দিতাম। আমাদের বাসায় রেডিও ছিল একটা। আমার বয়স তখন চার কি পাঁচ। আব্বু বিভিন্ন ক্যাসেট আনতেন। আমি রেডিও নিয়ে বসে যেতাম একটা কোনায়। সাথে থাকতো সাইন পেন, কলম আর ডায়েরি। আমার কণ্ঠে তোলা প্রথম গান ছিল প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চু স্যার এর “সুখেরি পৃথিবী।” শুরুটা ওখানেই। আমি তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তালিম শুরু করিনি। ছোট্ট ছোট্ট হাতে, অজস্র বানান ভুলের সমাহারে লিরিক্স শুনে শুনে লিখতাম। আবেগ মেশানো ছিল খুব। লিজেন্ডারি আর্টিস্টদের শুনতাম। তখন তো নামও জানতামনা তাদের। গানের প্রতি টান দেখে আম্মু এবং আব্বু হারমোনিয়াম কিনে দেন। এরপর বিভিন্ন গুণী মানুষ, ওস্তাদজি এর সান্নিধ্য পাই। সেই থেকে শুরু হয় পথচলা। সময়গুলো খুব সুন্দর ছিল।
নব যুগান্তর: কথায় কথা উঠে আসলো। আপনার বর্তমান সঙ্গীত গুরু কে?
সুমনা: জীবনে অনেক গুরুজনের কাছ থেকে তালিম নেবার সৌভাগ্য হয়েছে। তবে মূলত আমি শ্রদ্ধেয় নিয়াজ মামুন স্যার এর কাছে শিখছি। ২০১৩ থেকে এখন পর্যন্ত ওনার কাছেই তালিম নিচ্ছি। উনি আমার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। আমি অনেক সৌভাগ্যবতী যে, ওনার মতন একজন ওস্তাদ পেয়েছি।
নব যুগান্তর: সঙ্গীত জীবনে আপনার আইডল হিসেবে কাকে গণ্য করেন?
সুমনা: গানের ক্ষেত্রে আমার সবথেকে বড় আইডল হিসেবে মানি শ্রদ্ধেয় রুনা লায়লা ম্যাম এবং মিতালি মুখার্জি ম্যামকে। মিতালি ম্যামকে সেরাকণ্ঠে পুরো জার্নিতে জাজমেন্ট প্যানেলে পেয়েছিলাম স্বপ্ন সত্যি হবার মতন। রুনা লায়লা ম্যামের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হবার সৌভাগ্য এখনো হয়নি। খুব গভীর একটা ইচ্ছে মরবার আগে যাতে রুনা ম্যামের পা ছুঁয়ে সালাম করতে পারি একটুখানি।
নব যুগান্তর: অবশ্যই আপনার আইডল রুনা লায়লা ম্যামের সাক্ষাৎ পাবেন। গান নিয়ে আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কে ছিলেন?
সুমনা: সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন মা। আসলে ছোটবেলায় গান নিয়ে যে স্বপ্ন দেখবো, তা ঠিক করা ছিলোনা। তবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা দেখতাম। ইচ্ছেটা ছিল, গুণীজনদের সামনে একদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে গাইবো। আমি ছিলাম প্রকৃতিপ্রেমী আর অন্য জগতের ইচ্ছে সেপাই। মায়ের আশা ভরসা থেকে একটা লক্ষ্য তৈরী হয়। আমার মা এবং বাবা দুজনেই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। মা এখানে সেখানে নিয়ে যেতেন শেখানোর জন্য। ওনারা এখনো প্রত্যেকটি পারফরম্যান্স এর আগে গান যাচাই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পরামর্শ দেন। এছাড়াও আমার গানের অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে আমি আমার বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছেও ঋণী।
নব যুগান্তর: আপনিতো চ্যানেল আই ক্ষুদে গানরাজ থেকে বাদ পড়েছিলেন? তখন সেই বাদ পড়াটা কিভাবে নিয়েছিলেন?
সুমনা: পঞ্চম শ্রেণীতে থাকতে ক্ষুদে গানরাজে নাম লিখিয়েছিলাম। আমার ওভারহাইটের কারণে বাদ পড়ি। স্বাভাবিক ভাবে মন তো খারাপ হবেই। তবে মহান আল্লাহ আমার ভাগ্যে এর থেকেও বড় কিছু রাখবেন, তা আশা করিনি। একটা কথা আছে, “Human rejection can be God’s divine protection.” এরপর, লাগাতার নিজেকে আরও প্রস্তুত করতে থাকি। টার্গেট ছিল চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠ- ২০১৭। আর আল্লাহর রহমতে, বিজয়ীও হয়ে গেলাম।
নব যুগান্তর: পড়াশোনা কেমন চলছে আপনার?
সুমনা: সত্যি বলতে, কোয়ারান্টাইনে পড়াশোনা এমন ভাবেই চলছে, যে চলতে চলতে ধরতে পারছিনা আর কি। ২০২১ এ এসএসসি দেব। তবে, অনলাইনে ক্লাসগুলো করছি এবং পড়ছি।
নব যুগান্তর: হা হা হা। কিসে পড়াশোনা করছেন আর কোথায়?
সুমনা: মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এন্ড কলেজে দশম শ্রেণীতে অধ্যানরত।
নব যুগান্তর: পড়াশোনার পাশাপাশি সঙ্গীত টাকেও সমানতালে এগিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে না?
সুমনা: পড়াশোনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি সংগীতের প্রতি সিরিয়াস বেশি। তবে, সবকিছু রানিং অবস্থায় সময় বের করতে কষ্ট হতো। তবে, দুটোকেই সমানতালে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। এখন তো ঘরে বসে। তাই, সময় বের করার ঝামেলা পোহাতে হয়না। আমি এই বিষয়গুলোকে সমস্যা না, বরং এনজয় করি।
নব যুগান্তর: আপনার ফেসবুক একাউন্ট ঘেঁটে দেখলাম অনেক সুন্দর আর্টও করেন আপনি। আর্ট নিয়ে কি কোনো স্বপ্ন আছে?
সুমনা: না। আঁকা-উঁকি শখের বসে করা হয়। যখন যেটা মাথায় আসে, আঁকি। ২০১৪-১৫ পর্যন্ত আর্টে নিয়মিত ছিলাম। এরপর, সংগীতে বেশি সময় দেয়া হয়েছে। আসলে আমার ছোটবেলা থেকে সবকিছুরই স্বাদ নেয়ার ইচ্ছেটা ছিল। আবৃত্তি, ডিবেট, অভিনয়, স্পোর্টস, ফটোগ্রাফি, কবিতা লেখা, ছবি আঁকা এই বিষয়গুলোতে তীব্র শখ ছিল। তবে, এর বহিঃপ্রকাশ বন্ধুমহলে, ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ ছিল।
নব যুগান্তর: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান সময় ব্যয় করে আমাদেরকে দেওয়ার জন্য। “নব যুগান্তর” এর পক্ষ থেকে আপনার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য অসীম শুভ কামনা রইল।
সুমনা: আপনাকে এবং আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। সবার আশীর্বাদ এবং ভালোবাসা কাম্য। আপনাদের অনুপ্রেরণাই আমার শক্তি। আমি যাতে স্রষ্টা এবং সৃষ্টির জন্য কিছু করতে পারি, তার জন্য দোয়া চাইছি। সবাই সাবধানে থাকবেন, ভালো থাকবেন।
নব যুগান্তর /সাগর