বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও আধুনিক শিক্ষার ইতি কথা

বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট ১৯৯২ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ হয়। কিন্তু কী ছিল সেই আইন? কেনই বা বাউবি নামকরণ? কেউ কেউ বলে, এটা বিশ্ববিদ্যালয় না শুধুমাত্র একটি বোর্ড। আবার কেউ বলে, এটা ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষার জন্য হয়েছে। কেউ বলে, কর্মজীবীদের জন্য হয়েছে। কিন্তু বাউবি আইনে কী আছে?
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানার আগে জানতে হবে দূর-শিক্ষণ শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে। দূর-শিক্ষন শিক্ষা উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে। আমরা যে শিক্ষা ব্যবস্থা দেখতে পাই সেটা হলো প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থা। অর্থাৎ এখানে ক্যাম্পাস থাকবে, একাডেমি ভবন থাকবে, আবাসিক হল থাকবে, অনেক কিছুই থাকবে।
কিন্তু, দূর-শিক্ষন শিক্ষা পদ্ধতিতে এর কিছুরই প্রয়োজন নেই। উৎকর্ষ প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে আপনি যেকোনো জায়গা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ শাইখ সিরাজ স্যারের বিখ্যাত কৃষি ভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘মাটি ও মানুষ’ দেখে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারছি। এর জন্য টিভি চ্যানেলই যথেষ্ট ছিল, আমাদের কোনো মাঠপর্যায়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। আবার আছে বিখ্যাত ‘টেন মিনিট স্কুল।’ এটিকে Distance learning system অথবা E-learning system, Online learning system বলা হয়ে থাকে।
এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করে শিক্ষা ও গবেষণা বিস্তারের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমে নাম ছিল Bangladesh Institute of Distance Education (BIDE)। যা ১৯৮৫ সালে শুরু হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল এবং তথ্য মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনা করতো। পরে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
নব্বইয়ের দশকে বাউবি কর্তৃক পরিচালিত এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। যার নাম কৃষিকৌশল। এই অনুষ্ঠান বিটিভি কর্তৃক সম্প্রচারিত হতো। কিন্তু এভাবে যদি হয়ে থাকে তবে বিশ্ববিদ্যালয় হয় কীভাবে?
বিশ্ববিদ্যালয় হলো শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য আর গবেষণা হয় নতুন নতুন আবিষ্কারের জন্য। বিশ্বের অনেক গবেষণা আর আবিষ্কার বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়েছে। বাংলাদেশে যখন বাউবি প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন দেশে এতো বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো না। বাউবি দেশের ১২তম বিশ্ববিদ্যালয়। তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শিক্ষা ও গবেষণার সমৃদ্ধ ও মানসম্মত যেমনই শিক্ষার প্রয়োজন তেমনই ধারা অব্যাহত বাউবিতে আছে। বাউবি-আইনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
বাউবি বর্তমানে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর বিশ্বে সপ্তম। মোট শিক্ষার্থীদের সংখ্যা পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজারের বেশি। ভারতীয় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বাউবিতে সকল বয়সের সকল শিক্ষার্থীদের নিম্নতর থেকে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ আছে। যা বাংলাদেশের অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই। কারণ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বাউবির একাডেমিক কাউন্সিল শিক্ষার জন্য কোনো সীমাবদ্ধতা রাখেনি।
আপনি যদি পুরাতন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস দেখেন তবে সেখানে তখন ফার্স্ট টাইম বা সেকেন্ড টাইম ছিল না। সবাই যোগ্যতা বলে ভর্তি হতে পারত। এখন সেটাকে তারা পরিবর্তন করে এই নিয়ম করেছে। কিন্তু বাউবি তা করেনি বরং শিক্ষার জন্য সবাইকে সুযোগ করে দিয়েছে। আপনি বাংলাদেশের যেকোনো জায়গাতেই অবস্থান করে যেকোনো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাউবি থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবেন।
শুধুমাত্র দূর-শিক্ষণ নয় এর সাথেও বাউবিতে নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক ক্লাস ও লাইব্রেরি-সুবিধা পেয়ে থাকে। বাউবি মূল ক্যাম্পাস গাজিপুরে MBA, Mphil, ও Ph.D এর পাঠদান হয় আর ঢাকা আঞ্চলিক ক্যাম্পাসে অনার্স, মাস্টার্সের ক্লাস হয়।
চাকুরীজীবী, নিয়মিত, অনিয়মিত সকল ধরনের শিক্ষার্থীরা এখানে উচ্চ ও গুণগতসম্পন্ন শিক্ষাগ্রহণ করে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য ১১টি আঞ্চলিক কেন্দ্র ও ৮০টি উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে। এর পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য বাউবি কোর্স অনুযায়ী ১৫০০র অধিক স্টাডি সেন্টার আছে। এই সকল স্টাডি সেন্টার শিক্ষার্থীদের নিকটস্থ করা হয়েছে ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়ার জন্য।
স্টাডি সেন্টারের জন্য বিভিন্ন কলেজ, স্কুল এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যবহার করা হয়। অদূর ভবিষ্যতে এসব আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রের মানোন্নয়ন করে শিক্ষার্থীদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে জানা যায়। বাউবির এরূপ গঠনগত ও কার্যপরিধির জন্য বাংলাদেশের সরকার যেকোনো শিক্ষানীতিতে বাউবিকে কাজে লাগাতে পারে। এর ফলে মোট লাভবান আমাদের দেশের জনগণই হবে। আমাদের দেশের জনগণ এখনো কুসংস্কারে আবদ্ধ আছে।
বর্তমানে করোনা মহামারির জন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয় দূরশিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু এ পদ্ধতি অন্যদের কাছে অপরিচিত ও অনভিজ্ঞ হলেও বাউবির শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন বিষয়। বাউবিতে অনলাইন ক্লাস, ই-বুক রয়েছে। যেখানে সকল পাঠ্যবইসহ আইনত আরো সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ আছে। সুতরাং ভবিষ্যৎ আশা এটাই থাকবে যে, সকল শিক্ষা ব্যবস্থা ছাপিয়ে বাউবির শিক্ষা ব্যবস্থা হবে দেশের সর্বোন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা।
লেখক- জিসান তাসফিক
আইন বিভাগ
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়